Ad Space 100*120
Ad Space 100*120

সয়াল্যান্ড লক্ষ্মীপুরে সয়াবিনের বাম্পার ফলন


প্রকাশের সময় : ১২ মাস আগে
সয়াল্যান্ড লক্ষ্মীপুরে সয়াবিনের বাম্পার ফলন

উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর সয়াবিন উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। সারাদেশে যে পরিমাণ সয়াবিন উৎপাদন হয়, এরমধ্যে ৮০ শতাংশ সয়াবিন চাষাবাদ হয় এই জেলায়। লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীর উপকূলীয় এলাকার মাটি ‘সয়াল্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত। এই জন্য জেলায় ব্র্যান্ডিং করা হয় সয়াবিনকে।
লক্ষ্মীপুরের সয়াল্যান্ড থেকে কৃষকের উৎপাদিত সয়াবিন গাছ কাটার ধুম পড়েছে। ক্ষেত থেকে সয়াবিন গাছ কেটে সেগুলো মাড়াই করে ঘরে তোলার ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষকেরা। এবার ফলনও ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন চাষিরা আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সময় মতো ফলন ঘরে তুলতে পেরেছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। স্থানীয়দের কাছে সয়াবিন সোনা হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সয়াবিনের বীজ বপন করেন চাষিরা।
চাষিরা জানায়, গেল বছর সয়াবিন কাটার আগেই অতিবৃষ্টিতে ক্ষেতেই অনেকের সয়াবিন পঁচে গেছে। এতে লোকসানের মধ্যে পড়তে হয়েছে কৃষকদের। কিন্তু এবার সয়াবিন কাটার সময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টি না হওয়ায় সয়াবিনের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি।
কৃষি বিভাগ বলছে, এ মৌসুমে জেলায় যে পরিমাণ সয়াবিন উৎপাদন হয়েছে— তার বাজারমূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মতো হবে। সয়াবিনের উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের সারিবদ্ধভাবে এবং উচ্চ ফলনশীল (হাইব্রিড) জাতের বীজ বপন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। হাইব্রিডের মধ্যে বিইউ—১, বিইউ—২, বারি—৬, বীনা—৫ ও বীনা—৬ জাতের সয়াবিন রয়েছে। এগুলোতে ফলন ভালো হয় এবং সময়কালও কম লাগে। বিইউ—১ জাতের সয়াবিন রোপনের পর ফলন আসতে ৮০ দিন সময় লাগে। যেখানে দেশীয় জাতের সয়াবিন ফলন উঠতে সময় লাগে ১০০ দিনের মতো। যেসব সয়াবিনে সময়কাল কম লাগে, সেগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে না। তাই সঠিক সময়ে পাকা সয়াবিন ঘরে তুলতে পেরেছক কৃষকেরা।
জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানায়, জেলায় এবার ৪১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সয়াবিনের আবাদ হয়েছে। গত মৌসুমে আবাদ হয়েছে ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে। আবাদ জমির মধ্যে জেলার রামগতিতে সবচেয়ে বেশি সয়াবিনের চাষাবাদ করা হয়েছে। এ উপজেলাতে এবার সয়াবিনের চাষ হয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে। এরপরের অবস্থান কমলনগর। এ উপজেলাতে আবাদ হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে। সদর উপজেলায় ৬ হাজার ৩০০, রায়পুরে ৬ হাজার ২০০ এবং রামগঞ্জে ১০০ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ হয়েছে।
জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ এবং পশ্চিম অ ল, রায়পুর, রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সয়াবিনের আবাদ হয়। নদীমাতৃক হওয়ার মেঘনার বিভিন্ন চরেও এখন ফলানো হয় সয়াবিন।
কৃষকরা জানায়, ধান বা অন্যকোন ফসলের চেয়ে সয়াবিনে লাভ বেশি। গত কয়েক বছর ধরে ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন। তবে বীজ, সার, ওষুধ, চাষাবাদ এবং শ্রমিক খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার উৎপাদন খরচও বেড়ে গেছে।
জেলায় এবার ৮৩ হাজার ২০০ মেট্রিক টন সয়াবিনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। এরই মধ্যে মাঠ থেকে প্রায় ৯০—৯৫ শতাংশের বেশি সয়াবিন কাটা হয়েছে।
সরেজমিনে সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, চররমনী মোহন কমলনগরের চর কালকিনি, তোরাবগঞ্জ, চরলরে রামগতির আলেকজান্ডার ও চর বাদাম এবং রায়পুরের দক্ষিণ চরবংশী এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে কৃষক এবং কৃষাণীরা দলবদ্ধ হয়ে ক্ষেত থেকে সয়াবিন কেটে গাছসহ রোধে শুকিয়ে মাড়াই করছেন। কেউ আবার ক্ষেত থেকে সরাসরি সয়াবিন মাড়াই করে ঘরে তুলছেন। সয়াবিন কেনার জন্য খুচরা ব্যবসায়ীরা মাঠে গিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে সয়াবিন সংগ্রহ করে আড়তে বিক্রি করছেন। চররমনী মোহন এলাকার কৃষক আবদুর সালাম বলেন, চরে সাড়ে তিন কানি জমিতে সয়াবিন আবাদ করেছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগেই সবগুলো সয়াবিন কেটে ঘরে তুলতে পেরেছি।
রামগতি উপজেলার সয়াবিন চাষি আনোয়ার হোসেন, সফিক, সেকান্তর ও বাহার উদ্দিন বলেন অন্য বছরের চেয়ে সয়াবিনের উৎপাদন এইবার ভাল হয়েছে। প্রতি কানিতে ফলন হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ মণের মতো। ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা ব্যয় হয় কানিতে।
জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ—পরিচালক ড. জাকির হোসেন বলেন, সয়াবিনের উৎপাদন বাড়াতে আমরা কৃষকদের সঠিক পরামর্শ দিয়েছি। এবার ফলন ভালো হয়েছে। প্রতি হেক্টরে গড়ে ২.২ টন করে ফলন এসেছে। বর্তমানে কেজিপ্রতি সয়াবিনের দাম ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। সে হিসেবে জেলাতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার সয়াবিন উৎপাদন হয়েছে। আর সয়াবিন কেন্দ্রীক ৬০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, চলতি মৌসুমে কৃষি বিভাগ থেকে জেলাতে ৬ হাজার ৭০০ জন সয়াবিন চাষিকে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। তাদের বীজ এবং সার দেওয়া হয়। এখানকার উৎপাদিত সয়াবিন দিয়ে পশু এবং মাছের খাদ্য তৈরী হয়। ফলে বিভিন্ন ফিড কোম্পানির কাছে সয়াবিনের চাহিদা রয়েছে। তারা কৃষকদের কাছ থেকে সয়াবিন কিনে নিচ্ছে। এতে ভালো দাম পাচ্ছে চাষিরা।
প্রসঙ্গত, সয়াবিনের পাতাসহ অন্যান্য অংশ এবং শেকড় অল্প সময়ের মধ্যে পচে—গলে মাটিতে জৈব সার তৈরি করে। এর ফলে মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ অনেক উন্নত হয়। মাটি হয় পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। সয়াবিন চাষের ফলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে পরবর্তী ফসলে সারের ব্যবহার অর্ধেক নেমে আসে। উৎপাদন খরচ কমে যায় ফলনওভালো হয়। বাণিজ্যিকভাবে সয়াবিন চাষে আমদানি নির্ভরতা কমানো, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, দারিদ্র দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব।
এ অ লে শস্য পরিক্রমায় রবি ফসল হিসাবে সয়াবিন একক ও অনন্য সাধারণ ফসল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। সয়াবিন চাষে ঝুঁকি ও খরচ বাদামের তুলনায় অনেক কম, লাভও বেশি। সয়াবিন কাটার পর ওই জমিতে আউশ ধানের ফলন খুব ভালো হয়। সয়াবিন বহুমুখী মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে। সয়াবিন মাটিতে নাইট্রোজেনের মাত্রা বৃদ্ধি করে। প্রতি আবাদ মৌসুমে হেক্টর প্রতি ২৫০ থেকে ২৭৭ কেজি নাইট্রোজেন সংযোজন করতে পারে। যা ফসলের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেনের শতকরা প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। সয়াবিন গাছের শেকড়ে ফুলন্ত অবস্থায় ১২—৪৩টি ধূসর বর্ণের গুটি থাকে। এ গুটিগুলোতে বায়োক্যামিকেল প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলীয় নাইট্রোজেন অবমুক্ত করার পর আপনা আপনি শুষ্ক হয়ে শেকড়সহ জৈব পদার্থ হিসেবে মাটিতে মিশে গিয়ে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।
সব ঋতুতেই সয়াবিন চাষ করা যায়। তবে রবি মৌসুমে সয়াবিনের ব্যাপক আবাদ হয়। এর শেকড়গুচ্ছ মাটির এক মিটার নিচে পর্যন্ত প্রবেশ করতে পারে। গাছের কান্ডে ফুল হয়। ফুল সচরাচর সাদা, গোলাপি ও বেগুনি রঙের হয়ে থাকে। একটি খোসায় বীজ জন্মে। আর এই বীজগুলোকেই সয়াবিন বলা হয়। বীজ রোপণের ৯৫ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়। হেক্টর প্রতি ১ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৫ টন উৎপাদন হয়ে থাকে। সয়াবিন গাছ ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার উঁচু হয়। এর বীজ অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। এটি ভোজ্য তেলের প্রধান উৎস।পরিণত বীজ থেকে শিশুখাদ্য, সয়া—দুধ, দই ও পনির, সয়া—স্যস তৈরি হয়। শুষ্ক বীজে আছে চর্বি, শর্করা ও প্রোটিন। গি­সারিন, রং, সাবান, প্লাস্টিক, মুদ্রণের কালি ইত্যাদি দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও সয়াবিন একটি অপরিহার্য উপাদান। কাঁচা সয়াবিন গাছ গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার্য। সয়াবিনের উচ্চ পুষ্টিগুণসহ নানান ব্যবহারে সয়াবিনের আবাদ দিন দিন বেড়েই চলছে।