Ad Space 100*120
Ad Space 100*120

লক্ষ্মীপুরের এক ইউনিয়নেই খুন ২৪ নেতাকর্মী


প্রকাশের সময় : ১ বছর আগে
লক্ষ্মীপুরের এক ইউনিয়নেই খুন ২৪ নেতাকর্মী
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নে গত ২৫ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ২৪ নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। নির্বাচনী বিরোধসহ নানা দ্বন্দ্বে গুলি করে কিংবা কুপিয়ে তাঁদের হত্যা করে প্রতিপক্ষ। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং এই দুই দলের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাই রয়েছেন।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে বশিকপুর বাজার এলাকায় যুবলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান (৩৫) এবং ছাত্রলীগ নেতা রাকিব ইমামকে (৩০) গুলি করে হত্যা করা হয়। নোমান জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং রাকিব জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক।

স্থানীয় ও দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইউনিয়ন পরিষদেই প্রথম দফাদার আবুল বাশারের পায়ে প্রকাশ্যে গুলি করেন আবুল কাশেম জিহাদী। একই বছর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান বাবুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর পর থেকে চলছে ধারাবাহিক সন্ত্রাস। একে একে হত্যা করা হয় ২৪ নেতাকর্মীকে। এর মধ্যে বিএনপির নেতাকর্মীও রয়েছেন।

এদিকে সর্বশেষ যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা হত্যার ঘটনায় গত রাত ৯টা পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। উদ্ধার করা যায়নি হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র। খুনিরা হত্যার পর দুই নেতার যে মোটরসাইকেল নিয়ে গেছে, তা-ও উদ্ধার হয়নি।

গতকাল বিকেলে বশিকপুর এসডি কামিল মাদরাসা মাঠে নিহতদের জানাজা হয়। এতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেয়। এ সময় বক্তারা ইউনিয়নবাসীর জীবনের নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে ধরে দ্রুত খুনিদের গ্রেপ্তার ও অস্ত্র উদ্ধারের দাবি তোলেন।

নোমান-রাকিব হত্যায় কেন্দ্রীয় যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল এক বিবৃতিতে শোক জানিয়েছেন। একই সঙ্গে ঘটনায় জড়িত সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি জানান তাঁরা।

এ ছাড়া হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক তাফাজ্জল হোসেন চৌধুরী টিটু। তিনি বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করতে না পারলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।

স্থানীয় ও দলীয় সূত্রে আরো জানা গেছে, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে বশিকপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সহসভাপতি আলাউদ্দিন পাটওয়ারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর আগে ২০২১ সালের ৪ আগস্ট হত্যা করা হয় ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদকে। ২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর ঘুমন্ত অবস্থায় যুবলীগ নেতা মোরশেদকে হত্যা করা হয়। ২০১৫ সালের ১৭ জুন গলা কেটে হত্যা করা হয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজ উল্যাকে। একই বছরের ২১ মার্চ ওই ইউনিয়নে চাটখিলের আওয়ামী লীগ নেতা ব্যবসায়ী গোলাম মাওলাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালের ২৫ মে দিনদুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয় স্থানীয় বিএনপি নেতা সহোদর ইসমাইল হোসেন হোসেন চৌধুরী ও ইব্রাহিম হোসেন রতনকে। একই বছরের ৫ আগস্ট ৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মো. ফয়সালকে হত্যা করা হয়।

বশিকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আমির হোসেন বলেন, ‘আমরা সব সময় ভয়-আতঙ্কে থাকি। ঘরে-রাস্তায় কারো নিরাপত্তা নেই। ১৯৯৮ সালে শুরু হওয়া সন্ত্রাস এখনো চলছে। ২৪ জনের জীবন শেষ হয়েছে। অনেকেই পঙ্গু হয়েছে। কারা সন্ত্রাস করছে, কে বাহিনী পরিচালনা করছে, কারা তাদের গডফাদার, সবাই তা জানে। আমরা মুক্তি চাই, স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চাই।’

নোমান ও রাকিব হত্যাকাণ্ডে সরাসরি সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান আবুল কাশেম জিহাদীকে দায়ী করছে ভুক্তভোগী পরিবার। কাশেম জিহাদী চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ দুই নেতা খুন হওয়ার পর মঙ্গলবার রাতে সদর উপজেলা ও লক্ষ্মীপুর পৌর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। এতে নেতারা বিএনপি-জামায়াতকে দোষারোপ করেছেন।

তবে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট হাছিবুর রহমান বলেন, ‘নোমান ও রাকিবের স্বজনরা ঘটনার পর থেকেই কাশেম জিহাদীকে দায়ী করছেন। দলীয় কোন্দল ও আধিপত্য নিয়েই এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আওয়ামী লীগের লোকজন বিএনপিকে এ হত্যার ঘটনায় ফাঁসাতে চাচ্ছে। এর আগে আলাউদ্দিন হত্যার ঘটনায় আমাদের নেতাকর্মীদের মামলায় জড়ানো হয়েছে। এসব ঘটনায় আমাদের কোনো নেতাকর্মীই জড়িত নয়।’

নিহত নোমানের বড় ভাই ও বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘কাশেম জিহাদী ছাড়া আমাদের কোনো শত্রু নেই। সে-ই আমার ভাই ও রাকিবকে হত্যা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার ভাই হত্যার বিচার চাই।’

মাহফুজুর রহমান আরো বলেন, ‘নির্বাচনে আমার সঙ্গে হারার পর থেকে বিভিন্ন সময় কাশেম জিহাদী হুমকি দিয়ে এসেছিল। পরিকল্পিতভাবেই আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৯৮ সালের পর থেকে বশিকপুরে যত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সব কটি এই কাশেম জিহাদীই ঘটিয়েছে।’

কাশেম জিহাদীর হুমকির কথা তুলে ধরে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘সে নাকি জেলেরও বাঘ, বাইরেরও বাঘ। সে চেয়ারম্যানি চাইলে আমি দিয়ে দিতাম। আমার ভাইকে সে খুন করে ফেলেছে।’

নিহত রাকিবের বাবা রফিক উল্যা বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনের পর থেকেই জিহাদী আমার ছেলেকে হুমকি দিয়ে আসছে। গেল বছরের ২০ ডিসেম্বর পোদ্দারবাজার কায়কোবাদ অডিটরিয়ামে জিহাদী আমার ছেলেকে প্রকাশ্যে মারধর করেছে। পা ভেঙে দিয়েছে। তখন মামলা দিতে চাইলে পুলিশ নেয়নি। আমার ছেলেকে জিহাদীই হত্যা করেছে। নির্বাচনে তার বিরোধিতা করায় আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে।’

এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে আবুল কাশেম জিহাদীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়। ঘটনার পর থেকে তিনি এলাকায় নেই বলে জানা গেছে।

বশিকপুরের বাসিন্দা কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপপরিবেশবিষয়ক সম্পাদক শামছুল ইসলাম পাটওয়ারী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৯৯৮ সাল থেকে বশিকপুরেই একে একে ২৪টি খুন হয়েছে। অন্তত ১২ থেকে ১৫ জন এখনো পঙ্গু। কেউ পা, কেউ হাত, কেউ চোখ হারিয়েছে। কঠোরভাবে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে। এখানের বাসিন্দারা ২৪ ঘণ্টাই ভয়ে থাকে, কখন কী ঘটে!’

চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কাশেম চৌধুরী বলেন, ‘সন্ত্রাসের কোনো দল নেই। আমরা কোনো সন্ত্রাসীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিই না। দোষীদের গ্রেপ্তার করার জন্য প্রশাসনকে আহ্বান করছি। কাশেম জিহাদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তদন্ত করা হবে।’

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু বলেন, একের পর এক হত্যাকাণ্ডে জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সন্ত্রাসীদের হাতে হাতে বিপুল অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। সন্ত্রাসীর পরিচয় শুধুই সন্ত্রাসী। যে দলেরই হোক সন্ত্রাসীর কোনো ছাড় নেই।

গত রাত ৯টার দিকে জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাহফুজ্জামান আশরাফ সাংবাদিকদের বলেন, দুষ্কৃতকারীরা গুলি করে নোমান ও রাকিবকে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা করা হয়নি, তবে প্রস্তুতি চলছে। এখন পর্যন্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।

থানা পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন জানায়, মঙ্গলবার রাত পৌনে ১০টার দিকে বশিকপুর ইউনিয়নের নাগেরহাট এলাকায় সন্ত্রাসীরা যুবলীগ নেতা নোমান এবং ছাত্রলীগ নেতা রাকিবকে গুলি করে। এর আগে নোমান পোদ্দারবাজারে ছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে থাকা অন্যদের বিদায় দিয়ে তিনি রাকিবকে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে নাগেরহাটের দিকে যাচ্ছিলেন। নাগেরহাটের কাছাকাছি পৌঁছলে সন্ত্রাসীরা তাঁদের গুলি করে। তাঁদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ও মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। গুলির শব্দ শুনে ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় লোকজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাঁদের পড়ে থাকতে দেখে। মাথায় ও মুখে গুলিবিদ্ধ হয়ে নোমান মারা যান। গুলিবিদ্ধ রাকিবকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় নেওয়ার পথে রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনিও মারা যান।

নিহত নোমান বশিকপুর ইউনিয়নের বশিকপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে। তিনি (নোমান) প্রস্তাবিত জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক। আর নিহত রাকিব বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা এবং একই ইউনিয়নের নন্দীগ্রামের রফিক উল্যার ছেলে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ৫ এপ্রিল ওমরাহ করার জন্য নোমান সৌদি আরব যান। ২০ এপ্রিল তিনি দেশে ফেরেন। এরপর ঢাকার বাসা থেকে তিনি ঈদের দিন বশিকপুর গ্রামে আসেন। নোমানের স্ত্রী ও দুই ছেলে রয়েছে।